রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০১ অপরাহ্ন
ক্রাইমসিন২৪ অনলাইন ডেস্ক : বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও টানা নয় বছর ধরেই লোকসানে রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এসময় অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। এতো টাকা বিনিয়োগ করে মুনাফা তো দূরের কথা, পরিচালনা ব্যয়ই তুলতে পারছে না রাষ্ট্রয়াত্ত এ সংস্থাটি।
যদিও নিরাপদ-আরামদায়ক এ বাহনে বিপুল আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু উল্টো প্রতিবছরই লোকসানের ঘানি টানতে হচ্ছে রেলকে। পাশের দেশ ভারতে রেল প্রতিবছর মুনাফা করলেও, বাংলাদেশে রেল বরাবরই লোকসানি খাত।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেলের এ অবস্থার জন্য অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি দায়ী। অনিয়ম, দুর্নীতি রোধ করে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে এলে রেলকে লাভজনক খাতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে ভিন্ন কথা বলছেন রেল সচিব। তিনি বলছেন, রেল হচ্ছে গণপরিবহন। সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে রাষ্ট্র চালায় এ পরিবহন। এখানে মুনাফা করা সরকারের লক্ষ্য নয়।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত গত ৯ বছরে রেলে আয় হয়েছে ৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। আর পরিচালনা ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। মোট লোকসান হয়েছে ৯ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। অথচ গত ১০ বছর ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার রেলে বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
সবশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলের উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৬৩৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব এখনো পাওয়া না গেলেও এ বছরে লোকসান ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রেল খাতে ১২ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের র্যাংকিংয়ে ২০১১-১২ সালে বাংলাদেশের রেল অবকাঠামোর অবস্থান ছিল ১৪২টি দেশের মধ্যে ৭৩তম। সবশেষ ২০১৭-১৮ সালে ১৪০টি দেশের মধ্যে ৬০তম স্থানে চলে এসেছে দেশের রেল অবকাঠামো। এসময় রেলের সার্বিক স্কোরও ২ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ২ দশমিক ৯৪ (৭-এর মধ্যে)। অবকাঠামো উন্নয়নে র্যাংকিংয়ে উন্নতি হলেও আয় বাড়ছে এ প্রতিষ্ঠানের।
জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রেল খাতের উন্নয়নে নজর দেয়।
২০১১-১২ অর্থবছর থেকে রেলে অনুন্নয়ন (পরিচালনা) ব্যয়ের চেয়ে উন্নয়ন খাতে
(প্রকল্প বাস্তবায়ন) বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। গত ৯ অর্থবছরে (২০০৯-১০ থেকে
২০১৭-১৮) রেলের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে
উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে ২৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। পরিচালনা খাতে
ব্যয় করা হয়েছে ১৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। বাকিটা উন্নয়ন প্রকল্পে। এত বিপুল
ব্যয় সত্ত্বেও আয় বাড়েনি, বরং কমেছে।
রেলওয়ের অর্থ শাখার তথ্য অনুযায়ী ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেলের আয় ৫৮৪ কোটি টাকা,
পরিচালনা ব্যয় ১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা, লোকসান ৭৫৮ কোটি টাকা। ২০১০-১১
অর্থবছরে আয় ৬১৭ কোটি টাকা, পরিচালনা ব্যয় ১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, লোকসান
৯৫৮ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে আয় ৬২৯ কোটি টাকা, ব্যয় ১ হাজার ৬৭৯ কোটি
টাকা, লোকসান ১০৫০ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে আয় ৮০৪ কোটি টাকা, ব্যয় ১
হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা, লোকসান ৮০৩ কোটি টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আয় ৯৩১ কোটি
টাকা, ব্যয় ১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, লোকসান ৮০৩ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫
অর্থবছরে আয় ৯৫৬ কোটি টাকা, ব্যয় ১ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা, লোকসান ৮৭১ কোটি
টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয় ১ হাজার ২৩ কোটি টাকা, ব্যয় ২ হাজার ২২৯ কোটি
টাকা, লোকসান ১ হাজার ২০৬ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে আয় ১ হাজার ৩০৬
কোটি টাকা, ব্যয় ২ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা, লোকসান ১ কোটি ২২৬ কোটি টাকা,
২০১৭-১৮ অর্থবছরে আয় ১ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা, ব্যয় ২ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা,
লোকসান ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। প্রাপ্ত তথ্যনুযায়ী, প্রতি বছর রেলের লোকসান
বেড়েই চলছে।
তথ্যমতে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই দফায় রেলওয়ের ভাড়া বাড়ানো হয়। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেলের ভাড়া ৭ থেকে ৯ শতাংশ বাড়ানো হয়। এছাড়া ২০১২ সালেও বাড়ানো হয়েছিল ভাড়া। তারপরও লোকসান বেড়ে চলেছে রেলে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি রেলের আয় গড়ে ৫৬ পয়সা।
ব্যয় এক টাকা ৫২ পয়সা। পণ্য পরিবহনে প্রতি টনে রেলের কিলোমিটার প্রতি ব্যয়
২২ পয়সা, আয় হয় দুই টাকা ৫ পয়সা। পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় মূলত লোকসানের
বোঝা ভারি হচ্ছে রেলে।
রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, ২০০১-০২ অর্থবছরেও পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের আয় ছিল
প্রায় সমান। ১৬ বছর পর পণ্য পরিবহনে আয় নেমে এসেছে যাত্রী পরিবহনের চার
ভাগের এক ভাগে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে রেল পরিবহন করে তিন কোটি ৯১ লাখ ৬২ হাজার
যাত্রী। একই সময়ে পণ্য পরিবহন করে ৩৬ লাখ ৬৬ হাজার টন। রেলে এখন যাত্রী
প্রায় আট কোটি হলেও পণ্য পরিবহন কমে নেমেছে প্রায় ২৫ লাখ টনে। এক দশক আগেও
দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ১২ শতাংশ রেলের মাধ্যমে পরিবহন করা হতো।
এখন তা কমে পাঁচ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
রেলে পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ার পাশাপাশি লোকসানের অন্যতম কারণ কোচ (বগি), ওয়াগন ও ইঞ্জিন সংকট। ২০১১ সালের আগের ১০ বছরে কোনো ইঞ্জিন কেনা হয়নি। বর্তমান সরকারে সময়ে যাত্রীবাহী বগি কেনা হয়েছে ২৭০টি। পণ্যবাহী ওয়াগন কেনা হয়েছে ৪৪৬টি। ইঞ্জিন সংগ্রহ করা হয়েছে ৪৬টি। শিগগিরই রেলে নতুন আরো ৬০টি কোচ যুক্ত হবে।
জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, রেলে বিনিয়োগের সঙ্গে আয়ের সম্পর্ক নেই। এটা গণপরিবহন, সরকার মানুষের সেবা দিতে চালায় রেল। এখানে মুনাফার জন্য রেল চালায় না সরকার। এছাড়া রেলের ভাড়া তো ইচ্ছে করলেই আমরা বাড়াতে পারবো না।